
দু’কামরার
ফ্ল্যাট। আয়তনে সাকুল্যে ১২০০ স্কোয়ার ফিট। আর তাই নিয়ে আপনাদের যত
আক্ষেপ। ইস! আর ২০০ স্কোয়ার ফিট যদি থাকত, তা হলে একেবারে মনের মতো
সাজাতাম। অথচ দেখুন অন্দরসাজের সঙ্গে আয়তনের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কিন্তু নেই।
মানছি জায়গা বড় হলে দু’টো আসবাব বেশি রাখা যায়, কিন্তু ছোট জায়গা যে
সুন্দর করে সাজানো যায় না, এ যুক্তি মানতে পারলাম না। বাড়ি সাজানোর মূল
অস্ত্র তো আপনার হাতে। আর তা হল আপনার রুচিবোধ, ইচ্ছে আর প্র্যাগম্যাটিক
চিন্তাভাবনা। ঠিক যেমনটা করেছেন লোপামুদ্রা। বাড়ি সাজানোর শখ ছোট থেকেই।
আসলে সৃজনশীল মানুষ তো! গান ভালবাসেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা করেন নিয়মিত।
একটি বুটিকও আছে। ফলে নান্দনিকবোধ, পরিশীলিত রুচির অধিকারী লোপামুদ্রা। আর
তার সঙ্গে সুন্দর করে থাকার ইচ্ছেটাও প্রবল। ফলে ছোট্ট জায়গাও দারুণ
সুন্দর ভাবে সাজিয়েছেন। চোখের আরাম, মনের আরামও বটে। ইএম বাইপাস সংলগ্ন
বিশাল কমপ্লেক্সে থাকেন লোপামুদ্রা, ওঁর স্বামী তুষার ও একমাত্র মেয়ে
সায়তী। বছর চারেক হয়েছে এই নতুন বাড়িতে শিফ্ট করেছেন। লেআউট অল্পবিস্তর
পাল্টে অনেক যত্ন সাজিয়েছেন। এখানে আছে অগুনতি বইয়ে ঠাসা বুকশেল্ফ, শু
ক্যাবিনেট। তার উপর সাজানো রয়েছে শখের ডোকরার জিনিস। ছোট একচিলতে জায়গা,
কিন্তু কী দারুণভাবে ব্যবহার করেছেন। ফয়ার কিন্তু আমাদের অনেকের ফ্ল্যাটেই
থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামান না। কিন্তু অবহেলিত
অংশ ও যদি মায়া মমতা দিয়ে সাজানো যায়, সেখান থেকেই কিন্তু ফুটে ওঠে বাড়ির
প্রতি ভালবাসা। ফয়ার শেষে দেওয়ালে অ্যান্টিক আয়না। তার ঠিক নীচে
শ্বেতপাথরের ঝুলন্ত টেবল। ডিজ়াইনটা ভারী সুন্দর। পাশেই রয়েছে অবনীঠাকুরের
বেশ কিছু আঁকা ছবি। টেবলের উপরে ডোকরার দুর্গামূর্তি। ‘‘আমি খুব ঘুরে ঘুরে
বাড়ির জন্য জিনিস যোগাড় করেছি। আর যেহেতু এটা আমার ভাললাগার জায়গা,
ভালবাসার জায়গা,তাই এতটুকু ক্লান্ত হইনি। আর অ্যান্টিক জিনিসের উপর আমার
খুব লোভ। আর একটা জিনিস খুব প্রিয় তা হল ট্রাইবাল মুখোশ।’’’ জানালেন
লোপামুদ্রা। ফয়ার পেরিয়ে চৌকো ড্রয়িং-ডাইনিং এরিয়া। কোলামেলা, পরিপাটি।
কালার স্কিমে নিয়েও যে ভাবনাচিন্তা করেছেন ভালই বোঝা যায়। সবুজ খুব প্রিয়
রং, আর সেই রঙের আভাস পেলাম ড্রয়িং এরিয়ায়। সঙ্গে খোলা ছাদ। আর তাতে অগুনতি
গাছপালা।
দুটো ডেক চেয়ার তো আছেই। আর আছেই ট্রাইবাল মুখোশ। কোনওটা পুরুলিয়া থেকে আনা
, তো কোনওটা দক্ষিণ আপ্রিকা, কোনওটা আবার মালয়শিয়া থেকে। টেরেসটা যে
লোপামুদ্রাদের খুব পছন্দের তা তার রং-রবপ দেখেই বোঝা যায়। দু’হাত ভরে
সাজিয়েছেন তাই। মেয়ে সায়তীর অবশ্য এতে কৃতিত্ব আছে। ‘‘আমার টেরেসটা আমার
কাছে সবুজ পৃথিবী, আমার গ্রিন কর্নার।সবুজ প্রিয় রং তো তাই।’’ হাসতে হাসতে
বললেন লোপামুদ্রা। আর সেই সবুজ রঙ থেকে ধার করেই যেন সাজিয়েছেন বসার জায়গা।
কাঠের সোফায় তাই সবুজ গদি, সবুজ কুসন। আবার রঙের একঘেয়েমি কাটাতে অপ
হোয়াইট সোপাও রেখেছেন মাঝখানে। আসবাবের ডিজ়াইন বেশ স্মার্ট আর স্লিক।
জায়গা বাঁচাতেই এই আয়োজন। ছোট ফ্ল্যাটে সাজানোর মুন্সিয়ানা কিন্তু এখানেই।
আয়তন বুঝে নির্বাচন করতে হয় আসবাব। এই যদি একটা ঢাউস লেদার কাউচ এখানে
থাকত, তা হলে খোলামেলা ব্যাপারটা যে অনেকটাই খর্ব হত তা বলার অপেক্ষা রাখে
না। আসবাবের ডিজ়াইন সবই লোপামুদ্রার করা। আর তাতে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন
সায়তী। সেন্টার টেবলটাও বেশ অভিনব। কারুশিল্পে পরিবারের সবার খুব ঝোঁক। আর
তাই তো কাঠের টেবলটপে জায়গা করে নিয়েছে মধুবনী পেন্টিং , দেওয়ালে সাজানো
আছে ফ্রেমবন্দি করা কাঁথাকাজ। প্লেসমেন্টের জন্য আরও আকর্ষণীয় লাগে। ডাইনিং
এরিয়া সংলগ্ন ওপেন কিচেন।
তার অর্ধেকটা আবার বানিয়ে ফেলেছেন বার ক্যাবিনেট । রান্নাঘরে একেবারে
আধুনিক, ধকধকে, তকতকে। ডাইনিং এরিয়ার দেওয়ালে জায়গা করে নিয়েছে রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের তরুণ বয়সের ছবি। আর একদিকে রয়েছে কোলাজ করে ফ্যামিলি ফোটো।
ল্যাম্প এনেছেন দিল্লি থেকে। নানা রঙের সমাহার তাতে। এই ছোট ছোট জিনিসগুলোই
কিন্তু আপনার অন্দরমহলে অন্য মাত্রা যোগ করতে পারে। শুদু চেনার চোখ
থাকাটা প্রয়োজন। টিভি ক্যাবিনেটের উপর ডোকরার একটা ছবি প্রেমবন্দি করা
দেখতে পেলাম। বেশ অভিনব আইডিয়া। ডোকরার বেশ কিছু পুতুও রয়েছে। ডোকরার
প্রতি যে লোপামুদ্র কতটা দূর্বলতা, তা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন। তবে শুদু
ভালবাসা থাকাটাই আসল নয়, কোন জিনিসটা কোথায় রাখলে দেখতে ভাল লাগবে, সেই
বোধটা থাকেও দরকার। না হলে ঘর ভরতি জিনিস আপনি রাখতেই পারেন, কিন্তু তাতেই
যে আপনার অন্দরসাদ বাহবা কুড়োবে তার কোনও মানে নেই। তাই তো বারবার
প্লেসমেন্টর কথা বলি, এত আলোচনা করি।
বাড়িতে ঘর দুটো। একটা স্বামী-স্ত্রীর, আরেকটা কন্যার। সায়তী কলেজে
পড়ে। নিজের ঘর নিজেই সাজিয়েছেন। হলুদ রঙের উজ্জ্বল দেওয়ালে সঙ্গে
সামঞ্জস্য রেখেই গরের আপহোলস্ট্রি। এখানেও দেখতে পেলাম সবুজের ছোঁয়া।
বিটলস, হ্যারি পটার যে খুব প্রিয় সেটা ঘরে ঢুকলেই বোঝা যায়। এখানেও আসবাবের
আধিক্য নেই, প্রয়োজনমতোই আছে। মাস্টার বেডরুম কিঞ্চিৎ বড়। একদিকে
দেওয়ালে রোমান্টিক মভ, বাকি দেওয়ালে সাদা। আপহোলস্ট্রিতেও তাই বোধহয়
গোলাপি কালার প্যালেটের প্রাধান্য। ঘরের লাগোয়া বারান্দাও আছে। সকাল ঘুম
থেকে উঠে এখানে দাঁড়িয়ে চা খাওয়াটা লোপামুদ্রার অভ্যেস। তাই তো কোনায় একটা
ছোট্ট চেয়ারও রেখেছেন। আসলে এই অন্দরসাজের গোড়ার কথাই বাড়ির সদস্যদের
পছন্দ, ভাললাগা, তাদের নিত্যদিনের অভ্যেস। আর এগুলোকেই একসবত্র বেঁধে
সাজানো হয়েছে বাড়ি। আর তাই তো এখানে আসবাব, আপহোল্স্টিার, শো পিস ,বকিছুর
সঙ্গেই জড়িয়ে আছে কোনও না কোনও গল্প। এখান মানুষজন আর অন্দরমহল কোনও আলাদা
এনটিটি নয়, একই সুর, লয়, ছন্দে আবদ্ধ।

Comments
Post a Comment