সোমবার (৯ মার্চ) কালের কণ্ঠ’র প্রথম পৃষ্ঠায় একটি বড় শিরোনাম ছিল—‘খালেদার জামিন আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, তথ্য দিতে দলের লুকোচুরি’। ১০ মার্চ আরেকটি বড় পত্রিকার খবর—‘খালেদা জিয়ার মুক্তি, দল পারছে না তাই পরিবারের চেষ্টা’।
দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় দুর্নীতির দায়ে হাইকোর্ট কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুই বছর ধরে জেলে আছেন। দলের পক্ষ থেকে জামিনের জন্য বহু ছলে, বহুবার আইনি লড়াই করে হেরে গেছে। আইনি লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পর বিএনপির আইনজীবী ও দলের পক্ষে যা বলা হয়, সেটি মামলায় হেরে যাওয়ার পর ছোট-বড় সব মানুষই বলে। অন্যায় ও দুর্নীতি করে নিজে স্বীকার করেছেন—এমন উদাহরণ বিশ্বে আছে কি না জানি না। খালেদা জিয়ার মামলা ও সাজা নিয়ে পাল্টাপাল্টি অনেক কথা মানুষ শুনেছে। আজ আমার লেখার উদ্দেশ্য সেটি নয়। বয়সজনিত কারণে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা, জেল থেকে মুক্ত করা নিয়ে পরিবার ও দলের মধ্যে মতপার্থক্য এবং শেষমেশ পত্রিকার খবর অনুযায়ী দলের অজান্তে ও অসম্মতিতে পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে মুক্তির জন্য আবেদন ইত্যাদি পর্যালোচনায় প্রশ্ন আসে তাহলে কি খালেদা জিয়া রাজনীতিকে গুডবাই জানাচ্ছেন।
ব্যতিক্রম বাদে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য যে রকম কাঠখড় পোড়াতে হয় এবং ঐতিহ্য ও দীর্ঘ চর্চার প্রয়োজন হয়, তার কোনো কিছুই খালেদা জিয়ার ছিল না। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা স্ত্রী হিসেবে দলের ঐক্য বজায় রাখার জন্য, কেউ কেউ বলেন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের মধ্যস্থতায় তিনি বিএনপির শীর্ষ পদে আসীন হন। যে কারণেই হোক দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ভেতরে খালেদা জিয়ার প্রতি একটা মোহ তৈরি হয়। তিনি দলের ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০৭-২০০৮ মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, যখন জিয়া পরিবারকে বাদ দিয়ে বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা দলকে পুনর্গঠনের চেষ্টা করেন। রাজনীতিতে আসার পর থেকে এবার জেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভেতরে থেকে অথবা বাইরে থাকলেও ক্ষমতাকে ভোগ-উপভোগ করেছেন, কখনো কোনো কিছুর অভাব হয়নি। ক্ষমতা হাতে থাকলে যা হয়, বড় বড় মানুষ সব সময় চারপাশে ঘুরঘুর করে এবং তোষামোদি আর চাটুকারিতায় ভরপুর থাকে অন্দরমহলসহ সব বৈঠকখানা। এখন তো সবই দুঃসহ স্মৃতি।
দীর্ঘদিন রাজনীতিতে থাকলেও রাজনৈতিক পরিপক্বতা, প্রয়োজনীয় ধৈর্য ও সহনশীলতা এবং কৌশলী হওয়ার নিদর্শন খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে পাওয়া যায় না। হতে পারে দলের কিছু কোটারিও গোষ্ঠী বা অন্য কোনো নেপথ্য শক্তির অকাট্য পরামর্শ সব সময় টেবিলে প্রস্তুত থাকার কারণে কখনো কোনো কিছু নিয়ে তাঁকে চিন্তা করতে হয়নি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন, ২০০১-২০০৬ মেয়াদে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে সরকারের অংশীদার করা, অশিক্ষিত, অযোগ্য ছেলে তারেক রহমানকে ক্ষমতাধর করা, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের খপ্পরে পড়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় প্রদান এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা প্রমাণ করে তিনি রাজনৈতিক পরিপক্বতার দ্বারা পরিচালিত হননি, হয়েছেন অন্য কারো পরামর্শে, যার সব কিছু হিতে বিপরীত হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের মতো মহাভুল কোন নেপথ্য শক্তির পরামর্শে করেছেন তার কিছু শব্দ এখন বাতাসে কান পাতলে শোনা যায়, যারা কখনো বাংলাদেশের মঙ্গল চায় না। শেষ বিচারে তারা যে বিএনপিরও বন্ধু নয় সেটিও এখন সবাই বুঝছেন। তাঁরা জামায়াতের বন্ধু। তারপর ২০১৫ সালের প্রথম দিকে তথাকথিত অবরোধের নামে ৯২ দিন একনাগাড়ে জ্বালাও-পোড়াওয়ের তাণ্ডব। যার পরিপ্রেক্ষিতে কানাডার একটি ফেডারেল কোর্ট তো একটা রায় দিলেন যে বাংলাদেশের বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল। এই অপরিপক্ব কাজের জন্যই বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে সত্য-মিথ্যা মামলায় সেই থেকে ঘরে থাকতে পারছেন না।

অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে কোনো লাভ হয় না। নিজেরা নিজেদের আঙিনায় গর্ত খুঁড়লে অন্যরা তো সেই সুযোগ নেবেই। ধরার এটাই নিয়ম। এই যে ঘটনাবলির সামান্য বর্ণনা, এগুলোর সব কিছু তো খালেদা জিয়ার একক সিদ্ধান্তে হয়নি। কিন্তু এর দায় ও পরিণতি ভোগ করছেন খালেদা জিয়া একাই। জেলে তো অফুরন্ত সময়, নিশ্চয়ই তিনি পেছনে ফিরে সব কিছু নতুন করে দেখার চেষ্টা করছেন। শীর্ষ নেতারা সবাই তো বাইরে। একমাত্র তিনিই জেলে। তাঁর বয়স হয়েছে। তারপর সংগত কারণেই নানা রোগে-শোকে আক্রান্ত। বহুবিধ সন্দেহবাদে মন-মেজাজ আক্রান্ত ও ব্যথিত হওয়াটাও স্বাভাবিক। বিগত দুই বছর বিএনপির নেতারা যেসব বাগাড়ম্বর করছেন, তার একমাত্র সম্বল খালেদা জিয়ার জেলহাজত। নির্দোষ খালাস পেয়ে বা পূর্ণ জামিনে জেল থেকে বাইরে এসে আগের মতো তিনি বিএনপির রাজনীতিতে আবার সক্রিয় হবেন—এমন কোনো রেখা এখনো দিগন্তে উদিত হয়নি। তাহলে বিএনপির নেতারা কী করবেন। শাঁখের করাত। খালেদা জিয়া জেলে থাকলে বিএনপি নেতারা সেটিকে সম্বল করে অন্তত মিডিয়ায় বাগাড়ম্বর চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু ৪০১(১) ধারা বা প্যারোলে বাইরে গেলে সেই সুযোগ আর থাকবে না। বিএনপির সিনিয়র নেতারা যখন বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আবেদনের বিষয়ে তাঁরা কিছু জানেন না, তখন বিষয়টি বুঝতে আর কিছু বাকি থাকে না।
জন্মের পর থেকে বিএনপি যেসব অ্যাসেট বা সম্বলকে অবলম্বন করে রাজনীতি করে আসছে, সেগুলো একে একে এভাবে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। জেনারেল জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতে যা করেছেন, তাকে রাজনীতি বলা চলে না। সামরিক শাসক হিসেবে সামরিক আইনের জোরে এবং সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে তিনি ক্ষমতায় থেকেছেন। কিন্তু তাঁর নিহত হওয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় মাধ্যমে ইতিবাচক প্রচার-প্রচারণার ফলে মানুষের একরকম একটা সহানুভূতি মৃত জিয়ার প্রতি তৈরি হয়েছিল। খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এসে প্রথম দিকে তার সুফল পেয়েছেন। কিন্তু মানুষ একসময় বুঝে ফেলে জিয়ার মৃত্যুকে পুঁজি করে বিএনপি রাজনৈতিক ফায়দা নিলেও প্রকৃতপক্ষে জিয়ার প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কারণ মানুষ দেখেছে, দুইবার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেও সিটিং রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যার বিচারের কোনো উদ্যোগ তারা নিল না।
পরিবারের সদস্যরা অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়েও জিয়া হত্যার বিচার চাইলেন না। তারপর এখন তো প্রমাণিত, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়া পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। অন্যদিকে জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক, এখন এটা বললে মানুষ কৌতুক বোধ করে। সুতরাং জিয়া মিথ বিএনপিকে আর কোনো সুবিধা দিচ্ছে না। বিএনপির সবচেয়ে বড় সম্বল ছিল ভারতবিদ্বেষী রাজনীতি। তাতে একসময় লাভবান হয়েছে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের মানুষ বুঝে গেছে এটা স্রেফ রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াতের সঙ্গে যৌথ শাসনামলে চরম ভারতবিরোধিতার বহু নিদর্শন দেখা গেছে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেস মিশ্রকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া নাকি কথা দিয়েছিলেন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয় তা তিনি দেখবেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কী ঘটেছে তা এখন সবাই জানে।
২০১৪ সালে বিজেপি আবার ক্ষমতায় এলে তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকায় আসেন। তখন হোটেল পর্যন্ত গিয়ে লবিতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যেভাবে সুষমা স্বরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন তাতে মানুষের কাছে বিএনপির ভারতবিরোধী রাজনীতির সব গোমর ফাঁস হয়ে যায়। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় এলে সাক্ষাতের সময় খালেদা জিয়ার কাছ থেকে তিনটি বিষয় জানতে চেয়েছিলেন। ২০১২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় এলে বিএনপি কর্তৃক তাঁকে কেন অসম্মান করা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী। তৃতীয় বিষয়টি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ক্রিটিক্যাল। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামে ধরা পড়া ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলার অধিকতর তদন্ত হলে খালেদা জিয়া তাতে সহযোগিতা করবেন কি না। এসব ঘটনার মাধ্যমে বিএনপির ভারতবিরোধী রাজনৈতিক সম্বল যেমন শেষ হয়ে গেছে, তেমনি শত দৌড়ঝাঁপ করলেও ভারতের কৃপা লাভের কোনো সুযোগ নেই। বিএনপির আরেকটি বড় সম্বল ছিল জামায়াতের ক্যাডার বাহিনী। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এখনো বহাল থাকলেও তাদের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে বিএনপিকে আর সহযোগিতা করছে না। জামায়াতকে যারা চেনে তারা জানে বিএনপিকে মাঠ দখলের সহযোগিতায় জামায়াত আর আসবে না। গেল জামায়াতি সম্বল। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিএনপির আরেক অবলম্বন। আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির সমীকরণে পাকিস্তান এখন মহামারিতে আক্রান্ত। আগের অবস্থা আর নেই। পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া। সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত। সুতরাং বাংলাদেশের বিএনপির দিকে তাকানোর ক্ষমতা এখন আর পাকিস্তানের নেই। তাহলে রাজনৈতিক সম্বল বিএনপির আর থাকল কী। আছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ, যারা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ছয় দফা, অর্থাৎ স্বাধীনতার ম্যান্ডেটকে সমর্থন দেয়নি, সেই জনগোষ্ঠী এখনো চরম আওয়ামী লীগবিরোধী। এই প্রায় চার কোটি মানুষ রাজনৈতিক অঙ্গনে কোথায় দাঁড়াবে—তার কোনো বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি। সুতরাং এখনো তারা বিএনপির সঙ্গে আছে। তবে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে, তাতে ওই ২৫ শতাংশ মানুষকে বিকল্প বের করতে হবে। নতুন করে ভাবতে হবে। সেদিন আর বেশি দূরে নয়। আর খালেদা জিয়া যদি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে যান, তাহলে ওই আওয়ামীবিরোধী ২৫ শতাংশ মানুষসহ বিএনপির সমর্থকদের ওপর তার একটা বিরূপ প্রভাব পড়বে।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
sikder52@gmail.com
Comments
Post a Comment