হয়ত সেও দেখতে পেত পৃথিবী
Published: 03 Mar 2020 11:52 AM
‘প্রিম্যাচিউর’ শিশুদের অনেকেরই অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
শিশুটির বয়স তিন বছর। বাবা
মা তাকে নিয়ে এসেছেন চোখের ডাক্তারের কাছে। শিশুটি কিছু দেখতে পায় না। পৃথিবীতে এত
আলো। কিন্তু ওর ছোট দুটি চোখে শুধু অন্ধকার। ডাক্তার অনেকক্ষণ ধরে ওকে পরীক্ষা করলেন।
তারপর জানালেন, যদি ওর জন্মের ৩০ দিনের মধ্যে চিকিৎসা করা হতো তাহলে আজ অন্য দশজন শিশুর
মতো সেও দুচোখ মেলে দেখতো সব আলো, সব রং।
‘রেটিনোপ্যাথি অফ প্রিম্যাচিউরিটি’
সংক্ষেপে ‘আরওপি’। ‘প্রিম্যাচিউরিটি’ বা পূর্ণ সময় গর্ভবাসের আগেই অনেক শিশু জন্মগ্রহণ
করে। তাদের ওজনও হয় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। এই স্বল্প ওজনের শিশুদের মধ্যে আরওপির
শিকার হয় অনেক শিশু।
তারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে
যেতে পারে। অথচ জন্মের পর ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সঠিক চিকিৎসা করতে পারলে তাদের বাঁচানো
যেতে পারে অন্ধ হওয়ার দুর্গতি থেকে।
৩৪ সপ্তাহের আগে যে শিশু জন্মগ্রহণ
করে তাকে অপরিণত বা প্রিম্যাচিউর শিশু বলা হয়।
বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার
উন্নতির ফলে শিশুমৃত্যুর হার কমছে। বাংলাদেশেও শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে।
আগে সাত বা আট মাস গর্ভবাসের পর যেসব শিশু জন্মাতো তাদের বেশির ভাগকেই বাঁচিয়ে রাখা
যেত না।
২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি হাজার জীবিত জন্মের মৃত্যুর হার ৩০। আগে এই হার ছিল অনেক
বেশি। এখন সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশু সোজা কথায় প্রিম্যাচিউর শিশুকে এনআইসিইউ (নিওন্যাটাল
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট)-এ রাখা হয়। ফলে শিশুটি বেঁচে যেতে পারে।
কিন্তু প্রিম্যাচিউর শিশুদের
অনেক শিশুর রেটিনায় রক্তসঞ্চালনের ধমনী ও শিরাগুলো পূর্ণতা পায় না। সে কারণে তাদের
অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক শিশু আরওপির শিকার হয়ে অন্ধ হয়ে যায়। এজন্য জন্মের
২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে দেখতে হয় শিশুটির আরওপি আছে কিনা। থাকলে সঙ্গে
সঙ্গে সঠিক চিকিৎসা নিতে হয়। কারণ ৩০ দিনের পর এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৪০ দিনের পর
আর চিকিৎসা নিয়েও লাভ নেই।
খুব সংক্ষিপ্ত একটি সময়। আর
এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই সঠিক চিকিৎসা নিলে শিশুটি সুস্থ দৃষ্টিশক্তি নিয়ে বেড়ে উঠতে
পারে। নইলে তার সারা জীবন হয়ে যেতে পারে অন্ধত্বের আবরণে অন্ধকার।
বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৩০
লাখ শিশু জন্মগ্রহণ করে। এদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ বা চার লাখ শিশুর জন্ম হয়
অপরিণত অবস্থায়। এসব অপরিণত শিশুদের মধ্যে আবার ২০ থেকে ২২ শতাংশ আরওপির ঝুঁকির মধ্যে
থাকে। উপযুক্ত সময়ে চিকিৎসা দিতে পারলে এদের বাঁচানো সম্ভব অন্ধত্ব থেকে।
এই তথ্যগুলো জানা গেল সম্প্রতি
এক সেমিনারে।
ঢাকায় প্রেস ইন্সটিটিউট অফ
বাংলাদেশের মিলনায়তনে অরবিস ইন্টারন্যাশনাল ও পিআইবির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে
উপস্থিত ছিলেন এদেশের চক্ষু বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের
সহযোগী অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী, অরবিস ইন্টারন্যাশনালের ঊর্ধ্বতন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ
ডা. লুৎফুল হোসেন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ
শহিদুল্লাহ, পিআইবির মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ, প্রসূতি ও গাইনি সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক
সামিনা চৌধুরী, মহাসচিক অধ্যাপক সালেহা বেগম ও সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রওশন আরা, বাংলাদেশ
নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক এবং অরবিস ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক
প্রোগ্রামস মোহাম্মদ আলাউদ্দিন।
আরওপি বিশেষজ্ঞ ডা. নুজহাত
চৌধুরী বলেন “পুরোটাই হলো একটি সোনালি জানালার বিষয়। ২০ থেকে ৩০ দিন। সোনালি জানালার
একটি সময় শিশুর জীবনে। এই জানালা যদি খোলা যায়, শিশুটির যদি ঠিক সময়ে চিকিৎসা হয় তাহলে
সে বেঁচে থাকবে সুস্থ দৃষ্টিশক্তি নিয়ে। আর এই সোনালি সময়টুকু পেরিয়ে গেলে তার জীবনে
আলোর জানালা বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে। এর আর কোনো চিকিৎসা নেই।”
“এজন্য সচেতন হতে হবে অভিভাবককে
এবং চিকিৎসককে। গায়নোকোলজিস্ট, শিশু বিশেষজ্ঞ এবং চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞকে একযোগে কাজ করতে
হবে। আর অভিভাবকের সচেতনতা তো আছেই। শিশু যেন পূর্ণ সময় মাতৃগর্ভে বাস করতে পারে সেজন্য
চাই গর্ভবতী মায়ের সঠিক সেবা ও যত্ন। পুষ্টি তো চাই-ই, চিকিৎসা সেবাও চাই যথাযথ।” বললেন
তিনি।
পরামর্শ দিতে গিয়ে তিনি আরও
বলেন, “কম ওজনের প্রিম্যাচিউর শিশু যদি জন্ম নেয় তাহলে নবজাতককে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্রুত
তার চক্ষু পরীক্ষার ব্যবস্থা করবেন। জন্মের ২০ দিনের মাথায় পরীক্ষা করতে হবে। এর আগে
আরওপির লক্ষণ বোঝা যাবে না।”
বাংলাদেশে আরওপি চিকিৎসার ব্যবস্থা
আছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও ময়মনসিংহে। দেশের সর্বত্র এটা থাকা প্রয়োজন।
ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেল
বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষু ইন্সটিটিউট এবং বারডেম হাসপাতালে
স্বল্প মূল্যে বা বিনামূল্যে আরওপি সনাক্তকরণ ও এর চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।
Comments
Post a Comment